আরাফার দিনের রোজার ফজিলত, আমল ও নিয়ম | হাদিস সহ বিস্তারিত আলোচনা
![আরাফার দিনের রোজার ফজিলত আরাফার দিনের রোজার ফজিলত](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgAWwPjXDGYI_6HAqLw25Usv6MoekhehUePfJtK0pbrh-joeZik6b5R2JFrsvUbFcwFU-GyiDY_EpqATWIWkLE1lVc8sdAnVHd2evmT5LxQt2h3oT4n4lVk2CZZvL4i5K-D912IB9WB_8a51RwBmhR42LMCnROmcl-Xzn6ASEopb-vVdGeFIqajlB7o/s16000-rw/%E0%A6%86%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AB%E0%A6%BE%E0%A6%B0%20%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0%20%E0%A6%B0%E0%A7%8B%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%B0%20%E0%A6%AB%E0%A6%9C%E0%A6%BF%E0%A6%B2%E0%A6%A4.webp)
আরাফার দিনের রোজার ফজিলতঃ আসসালামু আলাইকুম প্রিয় পাঠক, আশা করি ভালো আছেন। আজকের আর্টিকেল টি আপনার উপকারে আসতে পারে। কেননা আজকে আমরা আপনাদেরকে আরাফার দিনের রোজার ফযীলত সম্পর্কে জানাবো।
আরবি বছরের শেষ মাস হল জিলহজ মাস। আরাফার দিন হল ইয়াওমুল আরাফা বা ৯ জিলহজ তারিখে, যেদিন হাজীরা হজের প্রধান ফরজ অকুফে আরাফা বা আরাফা প্রান্তরে অবস্থান করে থাকেন।
যে রোজা রাখার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বান্দার পূর্বের একবছর এবং পরের এক বছরের গোনাহ মাফ করেন সেটাই হলো আরাফার দিবসের রোজা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘ইয়াওমে আরাফার রোজার বিষয়ে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী, নিশ্চয়ই তিনি এর দ্বারা আগের এক বছরের ও পরের এক বছরের সকল গোনাহ মাফ করবেন’। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ১১৬২)।
আরাফার এ রোজা ফরয ওয়াজিব বা মুস্তাহাব এরকম কিছু না। এ রোজা না রাখলে গোনাহ হবে না। তবে এ রোজার ফজিলত অন্যান্য নফল রোজার চেয়ে অধিক।
আরাফার রোজা রাখার নিয়ম ২০২৪
আরাফার রোজা ফরয ওয়াজিব বা মুস্তাহাব এরকম কিছু না। আরাফার রোজার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলত পূর্ণ রোজা। আরাফার রোজার এই সময় অর্থাৎ জিলহজ্জ মাসে ১ তারিখ থেকে ১০ তারিখ অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
এই ১০ দিন বা ৯ দিন অন্য মাসের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই আরাফার দিনে রোজা রাখলে আল্লাহ তাআ’লা বলেছেন যে, সামনের ও পেছনের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দিবেন।
আমরা যে ভাবে রমজান মাসে রোজা রাখি ঠিক একই ভাবে এই আরাফার রোজা রাখতে হবে। ফজর আযানের পূর্বে সেহেরি খেতে হবে এবং মাগরিবের আজান দিলে ইফতার করতে হবে।
আরাফার রোজার নিয়ত সম্পর্কে আলোচনা
সেহরি খাওয়ার পর থেকে দিনের শেষ ভাগে মনে মনে পড়লেই আরাফার রোজার নিয়ত আদায় হয়ে যাবে। আরাফার রোজার নিয়ত ফরজ রোজার মত নিয়ত করলেই হবে।
বাংলায়, আমি আরাফার রোজার নিয়ত করছি, এভাবে নিয়ত করতে পারেন। আর আরবিতে করলেও হবে।
আরাফার রোজার অনেক ফজিলত আছে। এই রোজা রাখলে আল্লাহ তাআ’লা সকল মুসলমানদের সকল গুনাহ থেকে মাফ করে দেয়।
আরাফার দিবসের আমল সম্পর্কে জানুন
আমল একঃ রোজা পালন করা। এটা এদিনের সর্বোত্তম আমল। সহিহ মুসলিম শরিফের এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘আরাফার দিবসের রোজা, পূর্বের এক বছর ও পরের এক বছরের গুনাহের কাফফারা হয়ে যায়।’
তবে এ রোজা হাজিদের জন্য নয়, যারা হজে যায়নি- তাদের জন্য। হাজিদের জন্য আরাফার দিবসে রোজা রাখা মাকরুহ।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বিদায় হজের সময় আরাফার দিবসে রোজা রাখেননি। বরং সবার সম্মুখে তিনি দুধ পান করেছেন। -মুসলিম
আমল দুইঃ তাকবিরে তাহরিমাসহ জামাতে নামাজ আদায় করা। বেশি বেশি সিজদা করা অর্থাৎ নফল নামাজ পড়া।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বেশি বেশি সিজদা করা তোমার দায়িত্ব। কেননা, তুমি যদি আল্লাহর জন্য একটি সিজদা করো তাহলে আল্লাহ তোমার একটি মর্যাদা বাড়িয়ে দেবেন, আর একটি গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’ –সহিহ মুসলিম: ৭৮৮
আমল তিনঃ পুরুষের উচ্চ আওয়াজে একাকি তাকবির পাঠ করা। নারীরা নিম্নস্বরে তাকবির বলবে।
আমল চারঃ আরাফার দিনে বেশি বেশি দোয়া পাঠ করা। আরাফার দিনের উত্তম দোয়া হলো, যেগুলো রাসূলুল্লাহ (সা.) ও পূর্ববর্তী নবীরা পাঠ করেছেন।
ওই সব দোয়ার অন্যতম হলো- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়াহুওয়া আলা কুল্লি শাইয়্যিন ক্বাদির। ’
আমল পাঁচঃ চোখ, কান ও জিহ্বাকে হারাম কাজ থেকে বিরত রাখা। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আরাফার দিবসে যে তার কান, চোখ, জিহ্বাকে সঠিক কাজে ব্যয় করবে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে। ’ -শোয়াবুল ঈমান: ৩৭৬৬
আমল ছয়ঃ কোরআনে কারিম তেলাওয়াত করা। কোরআনের অর্থ ও তাফসির পাঠ করা।
আমল সাতঃ হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি দরূদ পাঠ করা।
আমল আটঃ সৎ কাজের আদেশ করা ও অসৎ কাজ থেকে অন্যকে বিরত রাখা।
আরাফাহ দিবসের ফযীলত
নিশ্চয়ই আরাফার রোজা অনেক ফযিলতপূর্ণ, আরাফাহ দিবসের বিভিন্ন ফযীলত রয়েছে। যেমন-
১. আরাফাহ দিবসের রোজা দু’বছরের গোনাহের কাফফারা
আরাফার দিন রোজা পালন করলে এক বছর পূর্বের এবং এক বছর পরের গুনাহ মাফ হয়। আবু কাতাদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে আরাফাহ দিবসের রোজা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন,‘আরাফার দিনের রোজা, আমি মনে করি বিগত এক বছর ও আগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা হিসাবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে’।
২. আরাফার দিন গুনাহ মাফ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের দিন
এ দিনে আল্লাহ স্বীয় বান্দাদের মধ্য থেকে অধিক সংখ্যক মানুষকে ক্ষমা করে দিয়ে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন।
আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,‘আরাফার দিন আল্লাহ রাববুল আলামীন তাঁর বান্দাদের এত অধিক সংখ্যক জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন, যা অন্য দিনে দেন না।
তিনি এ দিনে বান্দাদের নিকটবর্তী হন ও তাদের নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করে বলেন, তোমরা কি বলতে পার আমার এ বান্দারা আমার কাছে কি চায়’?
ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, এ হাদীছটি আরাফাহ দিবসের ফযীলতের একটি স্পষ্ট প্রমাণ।
৩. অধিক পরিমাণে যিকর ও দো‘আ করার উপযুক্ত সময়
নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,‘সবচেয়ে উত্তম দো‘আ হ’ল আরাফাহ দিবসের দো‘আ। আর সর্বশ্রেষ্ঠ কথা যা আমি বলি ও আমার পূর্ববর্তী নবীগণ বলেছেন
তা হ’ল- আল্লাহ ব্যতীত সত্যিকার কোন মা‘বূদ নেই, রাজত্ব তাঁরই, সকল প্রশংসা তাঁরই প্রাপ্য এবং তিনি সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান’।
এই দিনটি ‘ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ ও বিশ্ব মুসলিমের প্রতি আল্লাহর নিয়ামতের পরিপূর্ণতা প্রাপ্তির দিন।
হাদিসে এসেছে, “তারিক বিন শিহাব (রহ) হতে বর্ণিত, এক ইহুদি লোক উমর রা.কে বলল, হে আমিরুল মু’মিনিন! আপনাদের কিতাবে আপনারা এমন একটি আয়াত তিলাওয়াত করে থাকেন যদি সে আয়াতটি আমাদের প্রতি অবতীর্ণ হতো তাহলে আমরা সে দিনটিকে ঈদ হিসাবে উদযাপন করতাম।
তিনি বললেন, সে আয়াত কোনটি? লোকটি বলল, আয়াতটি হলো- আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীন পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জীবনবিধান হিসাবে মনোনীত করলাম।
উমর রা. এ কথা শুনে বললেন, আমি অবশ্যই জানি কখন তা অবতীর্ণ হয়েছে ও কোথায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং অবতীর্ণ হওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ সা. কোথায় ছিলেন। সে দিনটি হলো জুমার দিন। তিনি সে দিন আরাফার ময়দানে দাঁড়িয়ে ছিলেন।”
‘উমর রা. বর্ণিত হাদিসের ব্যাখ্যায় আবদুল্লাহ ইবন আববাস রা. বলেন, “আম্মার ইবন আবি আম্মার রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রা. সূরা মায়িদার উক্ত আয়াত তিলাওয়াত করলেন, তখন তাঁর নিকট এক ইয়াহুদি বসে ছিলো।
তিনি বলেন, যদি এ আয়াত আমাদের ইয়াহুদিদের ওপর নাজিল হতো, তাহলে আমরা সে দিনকে ঈদের দিন হিসেবে গণ্য করতাম। তখন আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রা. বলেন, এ আয়াতটি নাজিল হয়েছে দুটো ঈদের দিনে। তা হলো জুমার দিন ও আরাফার দিন।”
আরাফার ময়দানে অবস্থানরত হাজিদের ওপর আল্লাহতায়ালার অজস্র রহমত বর্ষিত হয়। এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, বদরের যুদ্ধের দিন বাদে শয়তান সবচেয়ে বেশি অপদস্থ, ধিকৃত ও ক্রোধান্বিত হয় আরাফার দিনে।
কেননা এ দিন শয়তান আল্লাহ পাকের অত্যধিক রহমত এবং বান্দার অগণিত পাপরাশি মাফ হতে দেখতে পায়। -মুয়াত্তা ও মিশকাত।
আরাফার দিন মুসলমানদের জিম্মাদারি গ্রহণের দিন, মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহর দীন ও নিয়ামত পরিপূর্ণতা এবং দীনের প্রতি আল্লাহ তায়ালার রেজামন্দি ঘোষিত হয়েছে।
সহিহ সনদে এসেছে, “আনাস ইবন মালিক রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সা. আরাফার ময়দানে সূর্যাস্তের পূর্বে বেলালকে রা. নির্দেশ দিলেন মানুষদেরকে চুপ করাতে।
বেলাল বললেন, আপনারা রাসূলুল্লাহ সা.-এর জন্য নীরবতা অবলম্বন করুন। জনতা নীরব হলো। রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, ‘হে লোকসকল! একটু পূর্বে জিবরাইল আমার কাছে এসেছেন। তিনি আমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আহলে আরাফা ও আহলে মুজদালিফার জন্য আমার কাছে সালাম পৌঁছিয়েছেন ও তাদের অন্যায়ের জিম্মাদারি নিয়েছেন।
উমর দাঁড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সা.! এটা কি শুধুই আমাদের জন্য? তিনি বললেন, এটা তোমাদের জন্য ও তোমাদের পর কিয়ামত পর্যন্ত যারা আসবে তাদের জন্য। উমর রা. বললেন, আল্লাহর অনুকম্পা অঢেল ও উত্তম।”
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আরাফার দিনের রোজার সওয়াব এক হাজার দিন রোজা রাখার সমান’। (তারগিব)।
পরিশেষে আমাদের কথা
আজকের আর্টিকেলে আমরা আরাফার রোজার ফজিলত ও সম্পর্কিত বিষয়ে আলোচনা করেছি। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে আরাফা দিবসের রোজা পালনের মাধ্যমে হাদীসে বর্ণিত ফজিলত হাসিলের তাওফিক দান করুন। আমিন।
আরাফার রোজা সম্পর্কে যদি আপনি আরও কিছু জানাতে চান তাহলে কমেন্টে আমাদের এবং পরবর্তী পাঠকদের জানাতে পারেন। আল্লাহ্ হাফেজ।